ড. মীর শরফ উদ্দিন আহমেদ১ ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান২
ভালো বীজ ভালো ফলনের ভিত্তি। অপরদিকে বীজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল উৎপাদন উপাদান, যা ব্যতীত ফলন আশা করা যায় না। এছাড়াও জাতের বিশুদ্ধতা প্রত্যক্ষভাবে ফলনের উপর প্রভাব ফেলে। জাতের কৌলিক বিশুদ্ধতা ও সংরক্ষণ সঠিকভাবে করা গেলে বীজ ভালো থাকে এবং তা থেকে ফলন ১০% বা তারও বেশি বৃদ্ধি পায়। তাই জাতের উচ্চ কৌলিক বিশুদ্ধতা বীজ উৎপাদনের একটি ǻরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। কারণ বীজ যে শুধু সংশ্লিষ্ট জাতের ধান গাছের মধ্যে স্ব-পরাগায়নের ফলে উৎপাদিত হয়েছে, তা শতভাগ নিশ্চিত করা জরুরি। কাজেই উপর্যুক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করে বীজ উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে সর্তকতা অবলম্বন করা প্রযোজন, যাতে মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদিত হয়।
প্রকৃত জাত : প্রকৃত জাত বলতে সেই জাতের প্রজননবিদ সংরক্ষিত নিউক্লিয়াস বীজ ও গাছের সকল বৈশিষ্ট্যসমূহকে বোঝায়। তাই যখন কোনো জাতের বীজ ও গাছ সেই জাতের নিউক্লিয়াস বীজের গাছের মতো একই ধরনের হয় এবং নিউক্লিয়াস বীজের সকল বৈশিষ্ট্যসমূহ ধারণ ও প্রকাশ করে, তখন সেই বীজ ও গাছসমূহকেও বিশুদ্ধ বা প্রকৃত জাত বলা যায়। এখানে প্রকৃত বলতে ‘জেনুইন’, ‘অথ্নেটিক’, ‘একই ধরনের’ বোঝানো হয়েছে। সুতরাং, একটি জাতের পরিচায়ক গুণসম্পন্ন গাছসমূহকেই প্রকৃত জাত বোঝায়, যা সেই গাছসমূহকে ওই ফসলের অন্য সকল জাত থেকে স্বতন্ত্র (ফরংঃরহপঃ), সমরূপ (ঁহরভড়ৎস) এবং স্থিতিশীল (ংঃধনষব) বৈশিষ্ট্য প্রদান করে (চিত্র ১)।
নিউক্লিয়াস বীজ প্রকৃত জাত অনুরূপ (ঞৎঁব ঃড় ঃুঢ়ব) চিত্র ১। নিউক্লিয়াস বীজ হতে প্রকৃত জাত ও ঞৎঁব ঃড় ঃুঢ়ব ধান গাছ।
প্রকৃত জাত সংরক্ষণের গুҺত্ব
জাতের বিশুদ্ধতা কমে গেলে একই হারে ফলনও কমে যায়। কারণ ফসলের বীজের প্রতি ১ শতাংশ অবিশুদ্ধতার জন্য ফসলের হেক্টর প্রতি ফলন ১০০ কেজি পর্যন্ত কমে যেতে পারে (গধড় বঃ ধষ., ১৯৯৬)। তাই সঠিকভাবে জাতের প্রকৃত বৈশিষ্ট্যসমূহ সংরক্ষণ করা প্রয়োজন ।
বীজ উৎপাদনের বিভিন্ন ধাপে বীজের কৌলিক বিশুদ্ধতা পর-পরাগায়নের মাধ্যমে অথবা বীজ প্রέিয়াজাতকরণের έটিজনিত কারণে বিনষ্ট হয়। ধান বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে রংড়ষধঃরড়হ ফরংঃধহপব কঠোরভাবে মেনে চলা দরকার। তাই প্রকৃত জাতকে রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি গুҺত্বের সংগে বিবেচনায় নিতে হয়।
এছাড়াও জাতীয় বীজনীতিতে উল্লেখিত বিভিন্ন মানসম্পন্ন শ্রেণির বীজ উৎপাদনের জন্যও জাতের প্রকৃত বৈশিষ্ট্যসমূহ সংরক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন।
প্রকৃত জাত সংরক্ষণ পদ্ধতি
ধান গাছের প্রতিটি জাতের প্রকৃত সকল বৈশিষ্ট্য ‘শীষ থেকে সারি’ (যবধফ ঃড় ৎড়)ি পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়। শীষ থেকে সারি পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য হলো প্রথম বছর বিশুদ্ধ বা প্রকৃত জাত হতে সুস্থ সবল, পোকা ও রোগমুক্ত এবং জাতের অনুরূপ (ঞৎঁব ঃড় ঃুঢ়ব) শীষ সংগ্রহ করে সম্পূর্ণ শীষটি মাড়াই ছাড়াই রোদে ৫/৬ দিন ভালোভাবে শুকাতে হয়। ধানের শীষগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচল করে এমন কক্ষে এবং মোটা পলি ব্যাগ বা প্লাস্টিকের বোতল বা বায়ুরোধী টিনের পাত্রে মাটি থেকে উঁচু স্থানে সংরক্ষণ করতে হয়। দ্বিতীয় বছর একইভাবে মাড়াই ছাড়াই সম্পূর্ণ শীষটি শোধন ও জাগ দেয়ার পর বীজতলায় বপন করা হয় (চিত্র ২)। ধানের চারা রোপণের সময় একইভাবে একটি সম্পূর্ণ শীষ হতে গজানো সকল চারাকে একটি সারিতে রোপণ করা হয় (চিত্র ৩)।
চিত্র ৩। মূল জমিতে একটি সম্পূর্ণ শীষ হতে গজানো সকল চারাকে একটি সারিতে রোপণ করা।
ফলে এই পদ্ধতিতে প্রথমে প্রতিটি বীজকে ǻছি ও শীষ (চিত্র ৪) এবং তারপর একটি শীষের এক সারির চারা ও এক সারির পূর্ণাঙ্গ গাছ (চিত্র ৫) হিসাবে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এরপর জাতের প্রকৃত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একই ধরনের (যড়সড়মবহড়ঁং) সারির গাছসমূহ যেগুলো প্রকৃত জাতের অনুরূপ, সেগুলো সংরক্ষণ করা হয় এবং ভিন্নরূপের (ংবমৎবমধহঃং) গাছসমূহের সারিগুলো কেটে ফেলা হয়।
চিত্র ৪। বীজতলায় শীষ থেকে সারি পদ্ধতি।
বিজাতীয় গাছ বাছাই : জাতের বৈশিষ্ট্য এবং বীজের বিশুদ্ধতা অক্ষুণœ রাখতে হলে বীজ ফসলের মাঠ থেকে বিজাতীয় গাছ বাছাই করতে হবে। ফলে পর-পরাগায়নের মাধ্যমে বীজের বিশুদ্ধতা নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকবে না। একই জাতের ধান গাছের মাঝে কিছুটা ভিন্ন ধরনের (ফবারধঃবফ) ধান গাছকে সংশ্লিষ্ট জাতের বিজাতীয় গাছ বলে। অন্যকথায় যেসব গাছের উচ্চতা, পাতা বা খোলের রঙ, থোড় আসার সময়, ফ্ল্যাগ লীফের কৌণিক বিস্তার, শীষের বিস্তার আকৃতি ধরন ও রł এবং বীজের আকার-আকৃতি রł ও ậłের উপস্থিতি জমির অধিকাংশ গাছ থেকে একটু আলাদা সেগুলোই বিজাতীয় গাছ। অন্যদিকে মিশ্রণ বলতে দুটি ভিন্ন জাতের ধান গাছকে বোঝায়। আবার, বীজ উৎপাদনের জমিতে সংশ্লিষ্ট জাতের ধান গাছ ছাড়া বিজাতীয় এবং পোকা ও রোগাক্রান্ত সকল ধান গাছ উঠিয়ে ফেলাকেও বিজাতীয় গাছ বাছাই বলে।
উপসংহার : খাদ্য নিরাপত্তার জন্য উন্নত ফসল ব্যবস্থাপনাসহ সঠিক জাত নির্বাচন ও মানসম্পন্ন বীজের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও বর্তমানে ধান চাষে ফলন ব্যবধান কমিয়ে আনার জন্য যথাযথ চাষাবাদ প্রযুক্তি ব্যবহারের সাথে মানসম্পন্ন বীজের ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ফলে ভালো ফসল বা ফলন পেতে পরিপুষ্ট, মিশ্রণমুক্ত, পোকার আέমণ ও রোগমুক্ত এবং কমপক্ষে শতকরা ৮০ ভাগ অঙ্কুরোদগম ক্ষমতাসম্পন্ন বীজ ব্যবহার করা প্রয়োজন, যা থেকে সুস্থ-সবল চারা পাওয়া যাবে। সুতরাং সঠিক বীজ উৎপাদন পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন ও কৃষক পর্যায়ে ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি।
সূত্র : বিজাতীয় গাছ শনাক্তকরণ ও বাছাই। ২০১৯। কৌলি সম্পদ ও বীজ বিভাগ। মুদ্রণ তত্ত¡াবধানে প্রকাশনা ও জনসংযোগ বিভাগ। ব্রি প্রকাশনা নম্বর ২৭০। মার্চ ২০১৯। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। গাজীপুর-১৭০১। য়
১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, জিনেটিক রির্সোস এন্ড সিড ডিভিশন, ব্রি, গাজীপুর।